সিলেটে চলছে মামলা বানিজ্য।
টাকা দিলেই কেটে দিচ্ছে নাম।
হাতিয়ে নিচ্ছেন মোটা অঙ্কের টাকা।
আর্থিক ফায়দা পেতেই একাধিক চক্র মানুষকে মামলার জালে ফাঁসাচ্ছে।
এম,এ রউফ সিলেটঃ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পর দেশে শুরু হয়েছে একদল স্বার্থান্বেষী লোকজনের দৌঁড়ঝাঁপ। তারা তাদের উদ্দেশ্য হাসিলের লক্ষ্যে নিরীহ-অসহায় ব্যক্তিদের মামলায় ঢুকিয়ে হয়রানী চালাচ্ছেন। হাতিয়ে নিচ্ছেন মোটা অঙ্কের টাকা। এমনও দেখা গেছে বিএনপি ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের দায়েরকৃত মামলায় নিজেদের দলের-সংগঠনের লোকদেরও আসামি করা হয়েছে। নিরপরাধ ও অসহায় ব্যক্তিদের আসামি করা হয়েছে। যা বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। আর্থিক ফায়দা পেতেই একাধিক চক্র এভাবেই মানুষকে মামলার জালে ফাঁসাচ্ছে ।
সিলেটে অনেক থানায় ৫ আগস্টের পট-পরিবর্তনের পর থেকে পতিত স্বৈরাচার সরকারের নেতাকর্মীদের আসামি করে মামলা দায়ের করছেন বিএনপিসহ আওয়ামী লীগ বিরোধী বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মীরা। দোষী কিংবা নির্দোষ কোনো কিছু যাচাই-বাছাই না করে একের পর এক বিভিন্ন থানায় কিংবা কোর্টে ঢালাওভাবে মামলা হচ্ছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় হতাহতের ঘটনায় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল ও পূর্বশত্রুতার জের মেটানোও হচ্ছে মামলার আসামি করে।
অভিযোগ এসেছে, সিলেটজুড়ে একাধিকচক্র মেতে উঠেছে মামলা-বাণিজ্যে। টাকা দিলেই কেটে দিচ্ছে নাম। আবার কেউ কেউ মামলার ভয় দেখিয়ে লুঁটে নিচ্ছে নানারকম ফায়দাও। মামলায় আসামি না করার জন্য দাবিও করা হচ্ছে মোটা অঙ্কের টাকা। এই হয়রানিমূলক মামলায় আসামি হচ্ছেন দিন মজুর থেকে শুরু করে সকল পেশার মানুষ। এমনকি মামলার আসামি হচ্ছেন বিএনপি নেতারাও। অনেক ক্ষেত্রে মামলার বাদী চেনেন না আসামিকে আর আসামি চেনেন না বাদীকেও।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের নামে মামলা হচ্ছে বিভিন্ন থানায়। মামলার এজাহারগুলো পর্যালোচনা করে দেখা গেছে অধিকাংশ মামলার এজাহারেই প্রথম ১০ থেকে ২০ জন আসামি আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাসহ প্রভাবশালী পুলিশ কর্মকর্তারা। এসব বিষয় নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে। মামলার অভিযোগ বা ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের নাম থাকছে তালিকার অনেক নিচের দিকে।
গত ২৪ অক্টোবর কুলসুম বেগম নামের এক নারী তার স্বামীকে হত্যার অভিযোগ এনে ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা করেন। এতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ১৩০ জনকে আসামি করা হয়। পরে ৮ নভেম্বর ঢাকার আশুলিয়া থানায় মামলাটি এজাহারভুক্ত হয়। গত ১১ নভেম্বর কুলসুমা বেগমের স্বামী আল আমিন নিজে সিলেটের দক্ষিণ সুরমা থানায় হাজির হয়ে তিনি মারা যাননি বলে জানান পুলিশকে। দক্ষিণ সুরমা থানা পুলিশ আশুলিয়া থানার সাথে যোগাযোগ করে তাকে আশুলিয়া থানায় হস্তান্তর করে।
আল আমিন মিয়ার পরিবার থেকে বলা হয়, পারিবারিক ঝামেলার কারণে কুলসুম স্বামীকে মৃত দেখিয়ে মামলা করেছেন। আল আমিন সিলেটের দক্ষিণ সুরমার পিরোজপুরের বাসিন্দা। মামলার প্রায় দুই সপ্তাহ পর তিনি জানতে পারেন, তাকে ‘মৃত’ দেখিয়ে স্ত্রী মামলা করেছেন। মামলা থেকে আসামির নাম প্রত্যাহার করার কথা বলে নাকি তার স্ত্রী লোকজনের কাছ থেকে টাকাপয়সাও নিচ্ছেন।
এমন আরও অনেক উদাহরণ তৈরি হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এমনই অনেক রহস্যময় মামলায় আসামি করা হচ্ছে বিএনপি ও ছাত্রদল নেতাদেরও। গোলাপগঞ্জ উপজেলার ফুলসাইন্দ গ্রামের মাসুম আহমদ বাদি হয়ে ৪৯ জনের নামে কোতোয়ালি থানায় দায়ের করা মামলায় (নং-২১(১১)২৪) ৩০ নং আসামি করা হয়েছে ফেঞ্চুগঞ্জ সারকারখানা ইউনিট ছাত্রদলের সভাপতি ও পরে উপজেলা স্বেচ্ছাসেবকদলের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করা আতিকুর রহমান রিফুলকে।
দলের সকল কর্মসূচিতে সরব উপস্থিত থাকা উত্তর ফেঞ্চুগঞ্জ মানিককোনা ইউনিয়ন বিএনপির সক্রিয় সদস্য রেজা ও পারভেজ তারাও একই মামলার আসামি। রহস্যময় এই মামলায় ৪১ নং আসামি করা হয়েছে প্রবাসী বিএনপি নেতা রেজা মিয়া ও ৪২ নং আসামি করা হয়েছে উত্তর ফেঞ্চুগঞ্জ ইউনিয়ন বিএনপি নেতা পারভেজ আহমদকেও। একই মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে ১৭নং আসামি নাটোর স্বেচ্ছাসেবকদলের সহ-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক হারুনুর রশিদ হারুন ও ১৮নং আসামি শ্রমিকদল নেতা আরিফ আহমদকে।
জগন্নাথপুর উপজেলার বাসিন্দা সাকিব। সিলেট সদর উপজেলার এক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর করা মামলার আসামি তিনি। ছাত্রজনতার আন্দোলনের সময় সাকিব হামলা চালিয়েছেন এমনটাই উল্লেখ করা হয়েছে মামলার এজাহারে। অথচ সাকিব ওই সময় দিল্লিতে ছিলেন ইউরোপ যাওয়ার স্বপ্ন নিয়ে। সরেজমিন সাকিবকে নিয়ে ওই বাদির সামনে গেলে তিনি চিনতেই পারেননি আসামিকে। মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি এড়িয়ে যান। এ ধরনের প্রশ্নবিদ্ধ মামলা প্রকৃত ভুক্তভোগীদের সঠিক বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে কতটুকু নেতিবাচক ভূমিকা পালন করবে।
এক জেলার বাসিন্দা অন্যজেলার মামলার আসামি। প্রতিনিয়ত হচ্ছে এরকম মামলা। আর এতে ফায়দা লুটছেন এক শ্রেণীর সুবিধাভোগীরা। মামলা বাণিজ্য নিয়ে অসন্তোষ্ট অনেকেই। এই মামলা বাণিজ্য নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন জেলার বিভিন্ন রাজনৈতিকদলের নেতারাও।
সিলেট জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক আব্দুল আহাদ খান জামাল বলেন, সহজ সরল বাদীকে ব্যবহার করে যারা স্বার্থান্বেষী মহল এই মামলা বাণিজ্য করে দলের ভাবমূর্তি নষ্ট করছেন তাদের বিরুদ্ধে আইনি এবং রাজনৈতকি তদন্তের দাবি জানাই।
বিএনপির কেন্দ্রীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক মিফতাহ সিদ্দিকী বলেন, আমরা সবাইকে বলে রেখেছি বিএনপির দায়িত্বশীল নেতাকর্মীদেরকে না জানিয়ে যেনো বিএনপির কেউ মামলা না করেন। আবার প্রশাসনকে বিএনপির পক্ষ থেকে অনুরোধ করা হয়েছে কেউ যদি মামলা করতে যান তাহলে তদন্ত সাপেক্ষে যেন মামলা নেওয়া হয়। কেননা এমনও বাদী দিয়ে মামলা করানো হচ্ছে বাদির ঠিকানা মোবাইল নাম্বার কিছুই নেই। আর কেউ যদি কোর্টে মামলা করে তাহলে সেই মামলার চার্জশিট গঠনের পূর্বে যেন সঠিক তদন্ত করা হয়। যাতে নির্দোষ কোনো মানুষ মামলা হামলার শিকার না হন। যখনই আমরা এমন কোনো ঘটনা শুনি তখনই আমরা সাথে সাথে সমাধানের চেষ্টা চালাই।
সিলেট মহানগর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি কয়েস লোদী এ প্রতিবেদক কে বলেন, যারা মামলা করছেন তারা গত আন্দোলনে হয় আহত কিংবা নিহত পরিবারের স্বজন। বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে এই সমস্ত মামলার আসামি
নির্ধারণে ক্ষেত্রে আমাদের যে তদন্তকারী কর্মকর্তা তিনি যেন তদন্ত পূর্বক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।
সিলেট জেলা বিএনপির সভাপতি আব্দুল কাইয়ুম চৌধুরী বলেন, আমরা স্পষ্ট বলে দিয়েছি কোনো নিরীহ মানুষ কিংবা ব্যক্তিগত আক্রোশ মিটানোর জন্য যদি কেউ মামলা করেন আর তিনি বিএনপির রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত থাকেন তাহলে আমরা তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেবো।